শ্রীশ্রীমায়ের দিব্যলীলা
জগদ্ধাত্রীরূপিণী:-
শ্রীশ্রীমায়ের চরণকমল কেমন ছিল তা স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "সুলক্ষণা জগদ্ধাত্রীর পা।"
মাকে জগদ্ধাত্রী রূপে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন ঘটনা ভক্তদের জীবনে অনেকবার ঘটেছে, বোধহয় সবচেয়ে বেশীবার ঘটেছে। শ্রীশ্রীমাকে জগদ্ধাত্রীরূপে দর্শন পেয়েছিলেন হলদিপুকুরের রামহৃদয় ঘোষাল, স্বামী হরিপ্রেমানন্দ, চন্দ্রমোহন দত্ত ইত্যাদি অনেকেই।
■রামহৃদয় ঘোষালের দর্শন:-
জয়রামবাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজা দেখতে এসেছেন হলদিপুকুর গ্রামের রামহৃদয় ঘোষাল। মা তখন ছোট বালিকা। ঘোষালমশাই দেবী জগদ্ধাত্রীর সামনে ধ্যানরতা বালিকা সারদাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বারবার দেখেও বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কে আসলে জগদ্ধাত্রী? ঐ মৃন্ময়ী মূর্তি নাকি এই চিন্ময়ী বালিকা সারদা? তখন তিনি ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
■হরিপ্রেমানন্দজীর ঘটনা:-
একদিন মায়ের সন্ন্যাসী শিষ্য স্বামী হরিপ্রেমানন্দ তাঁর পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে ভাবছিলেন, মা কি সত্যিই জগজ্জননী? জগজ্জননীর কি এমন শুষ্ক, শির বের করা বৃদ্ধার পা হয়? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তিনি মায়ের পায়ের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পেলেন। দেখলেন মায়ের পা দুটি সদ্য ওঠা সূর্যের মত রক্তাভ পায়ে রূপান্তরিত হল। তিনি দ্রুত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথায় সেই বৃদ্ধা? তার স্থান জুড়ে বসে রয়েছেন ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা, নানালঙ্কারে শোভিতা জগদ্ধাত্রী মুর্তি। তাঁর সর্বাঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে অপরূপ জ্যোতি। বিস্ময়ে সন্ন্যাসী সংজ্ঞাহীন হলেন। জ্ঞান ফিরলে দেখতে পেলেন মা তাঁর জ্ঞান উন্মেষের চেষ্টা করছেন।
■চন্দ্রমোহন দত্তের স্মৃতিকথা:-
চন্দ্রমোহন দত্ত, মায়ের মন্ত্রশিষ্য। একদিন মা জয়রামবাটী থেকে কামারপুকুর যাচ্ছেন, পথে মায়ের সঙ্গী চন্দ্রমোহন। হঠাৎ চন্দ্রমোহনের কি খেয়াল হল, তিনি মাকে গিয়ে বললেন, “মা তুমি কে? তোমার আসল স্বরূপ আমাকে দেখাও।” মা শুনে হেসেই কুটি-পাটি, বললেন “আমি আবার কে রে, আমি তোর মা”। কিন্তু চন্দ্রমোহনও নাছোড়বান্দা, কিছুতেই শুনবেন না, খালি আবদার, “না তোমাকে আজ দেখাতেই হবে, তুমি কে?” মা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, “শোন বাবা, আমার সেই রূপ কলিযুগের জন্য নয়, সে হয় না, আমি সেই রূপে কলিযুগে আবির্ভূতা হতে পারি না।“ চন্দ্রমোহন বলছেন, “তুমি চাইলে সব পারো, ওসব বলে আমাকে ভোলালে চলবে না।” অবশেষে মা হার মানলেন সন্তানের কাছে। রাজী হলেন দর্শন দিতে চন্দ্রমোহনকে, বললেন, “বেশ, তবে শুধু তুমিই দেখবে, আর কেউ নয়। তবে তার আগে প্রতিশ্রুতি দাও, আমার শরীর থাকতে এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলবে না। দেখ, আমি শরীরে থাকতে আমাকে কেউ চিনবে না, কিন্তু চলে গেলে তখন সবাই বুঝবে। এদিকে এস, আর দেখে যেন ভয় পেও না।” এই বলে মা আর চন্দ্রমোহন একটি গাছের তলায় গেলেন, তারপর চন্দ্রমোহন নিজেই তার বর্ণনা দিয়েছেন – “হঠাৎ দেখলুম, চারিদিক আলোয় আলোয় ভরে গেল, এত আলো যে আমি চোখ খোলা রাখতে পারছিনা, ঝলসে যাচ্ছে চারিদিক। সেই অপার্থিব আলোয় দেখলুম মায়ের জগন্মাতা রূপ। সিংহের উপর বসে আছেন, জ্যান্ত সিংহ, তার উপর মা চারিহাতে শঙ্খ-চক্র-ধনুক-বাণ নিয়ে জগদ্ধাত্রীরূপে উপবিষ্টা। পদ্মের আভা যুক্ত রাঙা চরণ, নখগুলি অর্ধচন্দ্রের শোভা সমন্বিত, গগনচুম্বী মুকুট, বিশাল বিশাল ত্রিনয়ন থেকে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, আর মায়ের দুপাশে দাঁড়িয়ে জয়া-বিজয়া মাকে বাতাস করছে, আমি আর দেখতে পারলুম না, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলুম, জ্ঞান হতে দেখি, মা আমার মা-সারদা সেই পল্লী-রমণীর বেশে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, “কি রে চন্দু, ভয় পেয়েছিলি? সাধ মিটেছে তো বাবা?” - এই হল মা।
■বাসনাবালা নন্দীর স্মৃতিকথা:-
"আমার তখন বারো তেরো বছর বয়স। জয়রামবাটীতে একদিন মায়ের কাছে পূজার সময় ঠাকুর দেখতে যাবার জন্য খুব বায়না করেছিলাম। কিন্তু মা যেতে মানা করলেন। মা আমাকে রাতে পায়ে তেল মালিশ করার সময় বললেন, 'তুই যা দেখার জন্য ব্যস্ত হচ্ছিস তা তুই এখানেই বসে দেখতে পাবি।' সেদিন মায়ের পায়ে বাতের তেল মালিশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল, চেয়ে দেখি চারদিক আলোয় আলো। এত আলো আমি জীবনে আর কোনদিন দেখিনি। যেন আলোয় ভাসছে সারা ঘর। আর সেই আলোর মধ্যে বসে আছেন জীবন্ত মা জগদ্ধাত্রী। ভয়ঙ্করী নয়, বড় স্নিগ্ধ, বড় সুন্দর সে রূপ, সে কী ঐশ্বর্য, চোখ তা ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু আজও চোখ বুঝলে মনে ভেসে ওঠে সেই রূপ। কিন্তু মা কে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি ভয় পেয়ে 'মা, মা' করে দরজার খিল খুলে বাইরে এলাম। কোথাও মাকে দেখতে পেলাম না। আবার ঘরের মধ্যে ফিরে গেলাম। দেখলাম মা যেমন শুয়েছিলেন তেমনি শুয়ে আছেন। ঘরের মধ্যে সেই আলো আর নাই। এক কোণে টিমটিম করে হ্যারিকেন জ্বলছে। মা কে ডাকলাম। মা উঠে বললেন, 'তুই দেখেছিস তো?' আমি যা দেখেছি, তা বললাম। মা মিষ্টি হেসে বললেন, 'যা দেখেছিস সব সত্যি।"
■জিতেন্দ্রকুমার সাহার অনুভূতি:-
"একবার মনে উঠল, বাড়িতে জগদ্ধাত্রীপূজা করব। মা তখন অপ্রকট, অর্থাৎ মায়ের দেহ চলে গেছে। একদিন রাত্রে দেখলাম - তিনি গ্রামের কালীমন্দিরের সামনে বসে আছেন। হঠাৎ মন্দির আলোয় আলোময় হয়ে উঠল। আমি তাকিয়ে আছি, মন্দিরে মা-কালীর মূর্তির দিকে। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল কালীমূর্তি, আমার সামনে সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী মূর্তি। তারপর সে মূর্তিও মিলিয়ে গেল। এবার দেখলাম শ্রীশ্রীমায়ের মূর্তি। তারপর আবার সেই কালীমূর্তি,আবার জগদ্ধাত্রী মূর্তি। বুঝলাম, যিনি জগদ্ধাত্রী,তিনিই কালী, তিনিই মা সারদা।"
যেখানে মায়ের নাম সেখানে আনন্দধাম 🌿🌿